darul uloom mahmudia madrasa

একটি আন্তর্জাতিক মানের আদর্শ  হিফজুল কুরআন প্রতিষ্ঠান

মহান মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের অবদান

‘আজ একশ্রেণির বামপন্থি মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের অবদানের কথা স্বীকার করতে চায় না। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় মাতৃভূমি এ বাংলাদেশ। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে কেনা আমাদের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজলে খুব সহজে তা হাতের নাগালে পাওয়া যায় না।

মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের অবদান অন্তরালে থাকর কারণে অনেকেই মনে করেন স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেমদের নেতিবাচক ভূমিকা ছিল। তাই দাড়ি টুপি দেখলেই আমরা স্বাধীনতা বিরোধী মনে করে।

অথচ অনেক মুক্তিযোদ্ধা দাড়ি রাখতেন, নামাজ পড়তেন, এবং এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা দাড়ি রাখেন, নামাজ পড়েন।

মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। আলেমদের ব্যতীত মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস হয় কীভাবে! তিনি বলেন, আজ আলেম সমাজ অনেক এগিয়ে আছেন। মানুষের জানা উচিত মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের অবদান কী?

১৯৭১ সালে অনেক হকপন্থী আলেম স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, অনেক আলেম সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। শহিদ হয়েছেন। অনেকে সরাসরি যুদ্ধ করেননি ঠিক তবে লুকিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। মানুষকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেছেন।

আজ এমনই কিছু আলেম মুক্তিযোদ্ধার কথা বলব যাদের কথা না বললে নয়।

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ: আব্দুর রশিদ ২৪৩ দিন আত্মগোপন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তার পরামর্শে অসংখ্য মানুষ যুদ্ধে অংশ নেয়, এবং এই কারণে পাকিস্তানী হানাদাররা তার বাড়ি-ঘর সব জ্বালিয়ে দেয়।

মাওলানা আবুল হাসান যশোরী: তিনি ছিলেন যশোর রেল স্টেশন মাদরাসার মুহতামিম। তার মাদরাসার ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল তার মাদরাসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে ২১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কে শহিদ করে, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সম্মানিত আলেম মাওলানা হাবীবুর রহমান এবং তার সাথে ছিলেন ৫ জন শাগরেদ আর বাকীরা ওখানে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধা। পরে মাদরাসা প্রাঙ্গনেই শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেয়া হয়। ওই হামলায় যাশোরী গুলিবিদ্ধ হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

মাওলানা মুহাম্মদ কামরুজ্জামান চিশতী: পুরান ঢাকার জুরাইনের পীর হিসেবে যিনি পরিচিত। কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের “মা” উপন্যাসে আজাদের মা সফিয়া বেগম তার ছেলে আজাদকে এই পুরান ঢাকার জুরাইনের পীরের নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। জুরাইনের পীরের বহু মুরীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিল এবং জুরাইনের পীর সাহেব নিজে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তথ্য সূত্র: আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে।

মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ.: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিলেন। সে সময় কওমি মাদরাসার কয়েক জন ছাত্র হুজুরকে জিজ্ঞাস করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?

তিনি বলেন, এটা হচ্ছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা জালেম আর আমরা হচ্ছি মজলুম। হাফেজ্জি হুজুরের এই কথা শুনে অনেক আলেম দেশের টানে ও নির্যাতীত নারীদের পাকিস্তানী হানদার বাহিনীর লালসার হাত থেকে বাঁচাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু নিজে হাফেজ্জি হুজুরের সাথে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।

শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ.: তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রধান মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা ও নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার উনাকে জোর করে সৌদিআরব পাঠিয়ে দেয়।

দেশ স্বাধীন হবার পর শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ. বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতীব হিসাবে নিযুক্ত করেন। তথ্য সূত্র: শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর জীবন ও কর্ম।

ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ.: ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড় কওমি মাদরাসা জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন তিনি। তাকে মধ্যপ্রাচ্যের আলেমরা একনামে চিনতেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়, তার ফতোয়া শুনে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার অনেক বড় বড় আলেম মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।

বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. তার নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। তথ্য সূত্র: ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ও উনার সাথীবর্গ।

এ রকম আর অনেক আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ রয়েছে যাদের অবদান বাংলার মানুষ ভুলেনি। হয়ত ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম নেই, কিন্তু তাদের নাম রয়েছে মাানুষের মনে।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যত নিবন্ধ, প্রবন্ধ এবং বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আলেমদের নেতিবাচক ভাবেই তুলে ধরা হয়েছে এবং হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম এসব বই, নাটক, সিনেমা দেখে আলেমদের বা দাড়ি টুপি দেখলেই রাজাকার মনে করে।

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসে আসা যাক। তিনি তার উপন্যাসে সাফিয়া বেগমের কথা উল্লেখ করেছেন। সাফিয়া বেগম তার ছেলে আজাদকে পুরান ঢাকার জুরাইন পীরের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই জুরাইন পীরের অনেক মুরিদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তারা কাজ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের রচিত ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রধান নায়ক একজন আলেম মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে তিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন। হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

বাংলাদেশর কওমী মাদরাসাগুলোর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় মাদরাসা চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মেজর জিয়াউর রহমান এই পটিয়া মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে হানাদার বাহিনী মাদরাসার উপর জঙ্গিবিমান দিয়ে বোমাবর্ষণ করে। এই বোমাবর্ষণে মাদরাসার উস্তাদ আল্লামা দানেশ ও কারী জেবুল হাসানসহ অনেকেই শহীদ হন।

১৯৭১ সালে মুফতি আমীমুল ইহসান রহ. এদেশের একজন প্রথিতযশা ইসলাম বিশেষজ্ঞ বুজুর্গ আলেম। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার তাকে জোর করে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের প্রধান খতীব হিসেবে নিযুক্ত করেন। (আমীমুর ইসলাম রহ.জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

আলেমদের থেকে গেরিলা কমান্ডার, মুজিব বাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডার, গেরিলা যোদ্ধা, সশস্ত্র যোদ্ধা, গোয়েন্দা মুক্তিযোদ্ধা, ‘রাজাকার’ মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্বিবৃত্তিক মুক্তিযোদ্ধা সবই আছেন এই তালিকায়। এক-দুজন নয়, দৃষ্টির সীমা প্রলম্বিত সেই তালিকা। সেদিন তারা মাতৃভূমির টানে নরপশু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরেছেন, মরেছেন ও শহীদ হয়েছেন। এটা ইতিহাসের অবিসংবাদিত সত্য-অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। এ সত্যকে পদদলিত করা হচ্ছে, ইতিহাসের পবিত্র দেহকে করা হচ্ছে ক্ষত-বিক্ষত। আলেম সমাজের গায়ে এঁকে দেয়া হচ্ছে রাজাকার, আল-বদরেরর অভিশপ্ত ফলক।

তাদের জন্ম ৭১-এর পরে হলেও! এ দেশের মানুষ কি ভুলতে পারবে বাঁশের কেল্লার শহীদ তিতুমীরের কথা? অজানা কি আজও হাজী শরীয়তুল্লাহ, পীর দুদু মিয়া, ফকীর মজনু শাহ এবং আরও অগণিত মুক্তি সংগ্রামী আলেম-ওলামার কথা? ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা নামক গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ লিখেছেন, হাশেম-সোহরাওয়ার্দী ও কিরণ শংকরের স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবির বেশ আগেই মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল হুদা পাঁচবাগী তার প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করেন। এ নিরিখে তাকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা বলা যেতে পারে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী ও মাওলানা তর্কবাগীশ প্রমুখ দেওবন্দী আলেমের সংগ্রামী ও দ্রোহী অবদানের ইতিহাস কি মিথ্যা? চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভোট যুদ্ধে সোহরাওয়ারর্দীর পাশাপাশি ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম, মাওলানা সিদ্দীক আহমদ এবং মাওলানা আতহার আলীর কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে কি? ছয় দফা আন্দোলনের অকুতোভয় সেনানী মাওলানা ওলীউর রহমানের কথা কী মুছে যাওয়ার?

স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম-ওলামারা কেবল সমর্থনই করেননি বরং লিপ্ত হয়েছেন পাকিস্তানি বর্বরদের মোকাবেলায়। হাজারও আলেম নিজ নিজ এলাকায় সংগঠিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন লাখোজন। সত্য সত্যই। সত্য চাপা থাকতে পারেনা কখনও। সময়ে তা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে নিজ ঔজ্জ্বল্যে।

তাই নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। এদেশের শত্রু-মিত্রদের চিনিয়ে দিতে হবে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের যে বীরত্ব ও অবদান রয়েছে তা মাানুষের কাছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ
১.আলেম মুক্তিযোদ্ধাদার খোঁজে,
২.স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র,
৩.আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের ভূমিকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বংলাদেশ।

ও ইসলামি পন্ডিতদের বই গবেষনায় ।

তথ সূত্র – যুবকন্ঠ

اردو، عربي ،Enlish